Friday, December 6, 2013

মু’মিনরা মুছার মায়ের মত- সন্তান লালন-পালন করা অন্যতম সৃষ্টির সেবা

সন্তান লালন-পালন করা অন্যতম সৃষ্টির সেবা হিসাবে গণ্য। মানুষ সন্তানকে এমনিতেই লালন-পালন করে থাকে। একাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে আল্লাহ-রাছুলের দেখানো পদ্ধতিতে করা হয় তাহলে তা ইবাদত - সৃষ্টির সেবা জাতীয় ইবাদত। রাছূল (সাঃ) থেকে জানা যায় যে, “মু’মিনরা মুছার মায়ের মত” অর্থাৎ মুছা(আঃ)-এর মা নিজের সন্তানেরই লালন-পালন করতেন এবং তা করেই ফেরাউন থেকে বেতন পেতেন। তদ্রুপ মু’মিনরা নিজ সন্তানকেই লালন-পালন করে এবং তা করে আল্লাহর কাছে বিনিময় পান। এচেতনা মু’মিনদের সন্তান লালন-পালনে শ্রমে ব্যয়ে অধিক শক্তি যোগাবে নিঃসন্দেহে। নীচে সন্তান লালন-পালনে ইসলামের নির্দেশ সম্পর্কে একটা আলোচনা তুলে ধরা হল - 

সন্তানের জন্য মা বাবার দায়িত্ব

আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনকে সন্তান-সন্তুতির মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করেছেন। পারিবারিক জীবনে সন্তান-সন্ততি কতবড় নিয়ামত তা যার সন্তান হয়নি তিনি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করে থাকেন। যাদেরকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে আদর্শবান রূপে গড়ে না তুলতে পারেন। কেননা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا مِـنْ مَـوْلُـودٍ إِلاَّ يـُولَـدُ عَــلَى الْــفـِطْـرَةِ فَـأَبـَوَاهُ يُهَـوِّدَانِـهِ ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ ، أَوْ يـُمَجـِّسـَانِهِ»
প্রতিটি নবজাতক তার স্বভাবজাত দ্বীন ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে (সহীহ বুখারী: ১৩৫৮) ।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দিন দিন যেভাবে অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা এবং চরিত্র বিধ্বংসী কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের সন্তানের উপর যেসব দায়িত্ব আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সন্তানকে লালন-পালন করা ঈমানের অন্যতম দাবী। আমাদের উপর সন্তানদের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো :
১. কানে আযান দেয়া : সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি পিতা-মাতার উপর এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বযে, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যাতে তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। হাদিসে এসেছে,
عَنْ عُـبـَيْـدِ اللـهِ بْنِ أَبِي رَافِعٍ ، عَنْ أَبِـيهِ ، قَالَ : رَأَيْـتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم «أَذَّنَ فِي أُذُنِ الْحـَسَنِ بْـنِ عَلِيٍّ حِـيـنَ وَلَـدَتْـهُ فَاطِمَةُ بِالصَّلاَةِ».
আবূ রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাসান ইবনে আলীর কানে আযান দিতে দেখেছি (সুনান আবূ দাউদ:৫১০৫)
২. সুন্দর নাম রাখা : বাচ্চার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন অনেক অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ ৪৯৫২-৪৯৬১)
৩. আক্বিকা করা : ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহর নামে যবেহ করা। হাদীসে এসেছে,
عَنْ سَمُرَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «كُـلُّ غُـلَامٍ رَهِـيـنَـةٌ بِعَـقـِيـقَـتِهِ تُـذْبَـحُ عَـنْـهُ يَوْمَ السَّابِعِ وَيُـحْـلَـقُ رَأْسُـهُ»
সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে। (সুনান আবূ দাউদ: ২৮৩৮)
৪. সদকাহ করা : ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ করা সুন্নাত। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রা. এর পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মুণ্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ কর। (সুনান আত-তিরমিযী: ১৫১৯) এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে খেজুর দিয়ে তাহনীক এবং বরকতের জন্য দো‘আ করতেন। (সহীহ বুখারী: ৩৯০৯; মুসলিম: ২১৪৬)
৫. খাতনা করা : ছেলেদের খাতনা করানো একটি অন্যতম সুন্নাত। হাদীসে এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ : «عَــقَّ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم عَـنِ الْـحَسـَنِ وَالْـحُـسَـيْـنِ وَخَــتــَنـَهُـمـَا لِـسَـبْعَـةِ أَيَّـامٍ».
জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন। (আল-মু‘জামুল আওসাত: ৬৭০৮)
৬. তাওহীদ শিক্ষা দেয়া : শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর তাওহীদ শিক্ষা দতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন,
«يَا غُـلَامُ إِنِّـي أُعَـلِّـمُـكَ كَـلِمَـاتٍ، احـْفَـظِ الـلَّهَ يَحـْفَـظْــكَ، احْـفَــظِ الـلَّهَ تَـجِـدْهُ تُـجَـاهَــكَ، إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ، وَإِذَا اسْـتَعَـنـْتَ فَاسْـتَعِــنْ بِالـلـَّهِ، وَاعْـلَـمْ أَنَّ الأُمَّـةَ لَـوْ اجْـتَمَعَتْ عَـلَى أَنْ يَـنـْفَـعُوكَ بِـشـَيْءٍ لَـمْ يَـنْـفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَـتَـبَهُ اللَّهُ لـَكَ، وَلَوْ اجْـتَـمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَـدْ كَــتَـبَهُ اللـَّهُ عَــلَـيْكَ، رُفِـعَـتِ الأَقْلَامُ وَجَـفَّـتْ الصُّـحُـفُ»
‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, তুমি তাঁকে সর্বদা সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে। (তিরমিযী: ২৫১৬)
৭. কুরআন শিক্ষা দান : ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। কেননা কুরআন শিক্ষা করা ফরয। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও। (জামিউল কাবীর)
কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»
‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ (সহীহ বুখারী:৫০২৭)
৮. সলাত শিক্ষা দেয়া ও সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করা : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যে পিতা-মাতা তার সন্তানকে সলাত শিক্ষা দিবেন এবং সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করাবেন। হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَـيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَـدِّهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى الـلَّهُ عَـلـَيْهِ وَسَلَّمَ: «مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُـمْ أَبْـنَاءُ سَـبْعِ سِـنِـينَ وَاضْـرِبُوهُمْ عَـلـَيْهَا وَهُـمْ أَبْـنَاءُ عَـشـْرٍ وَفــَرِّقُــوا بَـيـْنَهُمْ فِـي الْـمَضَاجِعِ»
আমর ইবনে শূয়াইব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সলাতের নির্দেশ দাও সাত বছর বয়সে। আর দশ বছর বয়সে সলাতের জন্য মৃদু প্রহার কর এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো। (সুনান আবূ দাউদ: ৪৯৫)
৯. আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া : সন্তানদের আচরণ শিক্ষা দেয়া পিতামাতার উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। লুকমান আলাইহিস সালাম তার সন্তানকে বললেন,
﴿وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾
﴿وَاقْصِدْ فِي مَـشْـيـِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَـرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَـمِـيـرِ﴾     
‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।’ ( সূরা লুকমান ১৮,১৯)
১০.আদর স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া : সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর স্নেহ করিনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না। (সহীহ বুখারী: ৫৯৯৭)
১১. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া : সন্তানকে দীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজ করা হয়েছে। কারণ দ্বীনি ইলম না জানা থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে। হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : «طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ»
আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয। (সুনান ইবন মাজাহ: ২২৪)
১২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা : সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে হবে।
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قُـلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَـلْ لِي مِنْ أَجْـرٍ فِـي بَنِي أَبِي سَلَمَةَ أَنْ أُنْـفِـقَ عَــلَــيْهِــمْ وَلــَسْـتُ بِــتَـارِكَــتِهِــمْ هَــكَــذَا وَهَــكَــذَا إِنَّــمَـا هُـمْ بَـنِيَّ قَالَ: «نَعَمْ لَكِ أَجـْرُ مَا أَنـْفَـقــْتِ عَــلَـيْهِـمْ»
উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে। (সহীহ বুখারী: ৫৩৬৯)
১৩. সক্ষম করে তোলা : সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা,তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,
«إِنَّــكَ أَنْ تَــدَعَ وَرَثــَتَــكَ أَغْــنِــيَـاءَ خــَيــْرٌ مِــنْ أَنْ تَـــدَعَــهُــمْ عَــالَـةً يــَتَـــكَـــفَّـــفُـــونَ الــنَّــاسَ فِي أَيـــْدِيهِــمْ»
তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। (সহীহ বুখারী:১২৯৫)
১৪. বিবাহ দেয়া : সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়া এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা এবং উপযুক্ত সময়ে বিবাহর ব্যবস্থা করা। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। (জামিউল কাবীর)
১৫. দ্বীনের পথে পরিচালিত করা : পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা। কুরআনে এসেছে,
﴿قُـلۡ هَٰــذِهِۦ سَـبـِيـلِيٓ أَدۡعُــوٓاْ إِلَى ٱلــلَّهِۚ عَــلَىٰ بَـصِيـرَةٍ أَنَـا۠ وَمَـنِ ٱتَّــبَعَـنِيۖ وَسُـبۡحـَٰنَ ٱللـَّهِ وَمَـآ أَنَـا۠ مِـنَ ٱلۡــمُــشۡرِكـِيـنَ ١٠٨﴾ )يوسف:108(
‘ বল, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’। (সূরা ইউসুফ : ১০৮)
সন্তানকে দ্বীনের পথে পরিচালনার মাধ্যমে সওয়াব অর্জন করার এক বিরাট সুযোগ রয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন,
«فَوَاللَّهِ لَأَنْ يُهْدَى بِكَ رَجُلٌ وَاحِدٌ خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ»
তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম। (সহীহ বুখারী)
১৬. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : সন্তানগণ পিতামাতার কাছ থেকে ইনসাফ আশা করে এবং তাদের মাঝে ইনসাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো’। (সহীহ বুখারী: ২৫৮৭)
১৭. ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে বিরত রাখা : ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে তাদেরকে বিরত না রাখলে এই সন্তানগনই কিয়ামাতে পিতামাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কুরআনে এসেছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارا ﴾ )التحريم:6(
হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। (সূরা আত-তাহরীম-৬)
﴿وَقَـالَ ٱلَّـذِيـنَ كَـفَـرُواْ رَبَّــنَآ أَرِنَــا ٱلّــَذَيۡــنِ أَضَــلَّانَا مِنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِ نَـجۡــعَـلۡهُمَا تَحۡــتَ أَقۡــدَامِــنَـا لِــيَكـُونَا مِنَ ٱلۡأَسۡــفَــلِــيـنَ ٢٩﴾ )فصلت: 29(
আর কাফিররা বলবে, ‘হে আমাদের রব, জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিন। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (সূরা হা-মীম আসসিজদাহ-২৯ )
১৮. পাপকাজ, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখা : সন্তান দুনিয়ার আসার সাথে সাথে শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং বিভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রুপে,পোশাক-পরিচ্ছেদের মাধ্যমে, বিভিন্ন ফ্যাশনে, বিভিন্ন ডিজাইনে, বিভিন্ন শিক্ষার নামে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে। তাই পিতা-মাতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓــأَيُّــهَا ٱلّـَذِينَ ءَامـَنـُوٓاْ إِنَّ مِنۡ أَزۡوَٰجِكُمۡ وَأَوۡلَٰـدِكُـمۡ عَــدُوّا لَّـكُـمۡ فَٱحۡــذَرُوهُــمۡۚ وَإِن تَعۡــفُــواْ وَتَـصۡفَـحُــواْ وَتَــغۡــفِــرُواْ فَـإِنَّ ٱللَّهَ غَـفُـور  رَّحِيمٌ ١٤ ﴾ )التغابن:14(
হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। (সূরা তাগাবুন-১৪)
হাদীসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : «لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْـمـُتَـشــَبِّـهِــيـنَ مِــنَ الرِّجَالِ بِالــنِّسَاءِ وَالْــمُــتــَشَــبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ»
ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন। (সহীহ বুখারী:৫৮৮৫)
আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم « مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ».
‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। (সুনান আবূ দাউদ:৪০৩১)
১৯. দো‘আ করা : আমাদের সন্তানদের জন্য দো‘আ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে,
﴿ وَٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُن وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ )الفرقان: 74(
আল্লাহর নেক বান্দা তারাই যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। (সূরা আলফুরকান-৭৪)
যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছিলেন,
﴿ هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُۥۖ قَالَ رَبِّ هَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّة طَيِّبَةًۖ إِنَّكَ سَمِيعُ ٱلدُّعَآءِ ٣٨ ﴾ ) آل عمران:38(
‘হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। (সূরা আলে ইমরান ৩৮)
সম্মানিত পিতামাতাবৃন্দ, আমরা কি সন্তানের হকগুলো পালন করতে পেরেছি বা পারছি ? আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে নেকসন্তান হিসাবে গড়ে তুলি। যে সম্পর্কে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ»
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-
১. সদকায়ে জারিয়া
২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়
৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দো‘আ করে [সহিহ মুসলিম:১৬৩১]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সন্তানদেরকে কবুল করুন,
তাদের হকসমূহ যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!

No comments:

Post a Comment