Saturday, February 22, 2014

আল-জাজিরায় প্রতিবেদন: বাংলাদেশের রিকশাচালকের হাসপাতাল

আল-জাজিরায় প্রতিবেদন: বাংলাদেশের রিকশাচালকের হাসপাতাল



ডেসটিনি ডেস্ক: সাধারণত বিত্তশালীরা সবাজসেবায় এগিয়ে আসেন। 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়'_ এমন পরিবারের কেউ ইচ্ছা করলেও অর্থাভাবে তা সম্ভব হয় না। এমন একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভবে পরিণত করেছেন জয়নাল আবেদীন নামে দেশের এক রিকশাচালক। তিল তিল করে অর্থ সঞ্চয় করে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি হাসপাতাল। সম্প্রতি আল-জাজিরায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
জানা গেছে, ৬১ বছর বয়সী এ রিকশা চালক ৩০ বছর যাবৎ প্রতিদিন ৬ ডলার পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করে একটি ছোট হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। প্রত্যন্ত এলাকার তানহাশাদিয়া নামক একটি গ্রামে তিনি ওই মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রতিদিন ওই হাসপাতালে ৩০০ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তবে ওই প্রতিবেদনে নির্মিত হাসপাতালের স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ বেশিরভাগ চিকিৎসকই শহরে থেকে কাজ করেন। পল্লী এলাকার মানুষদের জন্য এতদূরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে রিকশা চালক জয়নালের হাসপাতাল গ্রামের মানুষদের যে বড় উপকারে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ মহতী উদ্যোগের কারণে আল জাজিরার প্রতিবেদনে জয়নালকে একজন মহান জাতীয় ব্যক্তিত্ব বলে অভিহিত করা হয়েছে। খবর আল-জাজিরা অনলাইনের।



রিকশাচালক জয়নালের স্বপ্নেরমমতাজ হাসপাতাল

মো. কামরুজ্জামান তুহিন:: ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. দূরের প্রত্যন্ত চরাঞ্চল টান হাঁসাদিয়া গ্রামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জয়নাল আবেদীনের বৃদ্ধ পিতা আবদুল গনি এক রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাশের সিরতা বাজারের একমাত্র ওষুধের দোকান থেকেও ওষুধ পাওয়া যায় নি। কাঠের তক্তায় বাঁশ বেঁধে ভাইদের সহযোগিতায় অসুস্থ বাবাকে কিছু দূর নেয়ার পর তিনি মারা যান। বিনা চিকিৎসায় বাবার এমন মৃত্যু বিশ বছরের যুবক জয়নাল মেনে নিতে পারেননি। গ্রামের মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখেন হাসপাতাল গড়ার। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন অর্থ আর শিক্ষার। এর কোনোটাই তার নেই। ভূমিহীন কৃষক মো. আবদুল গনির চার ছেলে পাঁচ মেয়ের মধ্যে মো. জয়নাল আবেদীন সবার বড়। অভাবের সংসারে কারোরই লেখাপড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। অনেক ভেবে নিজ মনে শপথ নেন ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল করার মতো অর্থ নিয়ে আবার বাড়ি িরবেন। অন্যথায় আর কোনো দিন বাড়ি ফিরবেন না- এমন প্রত্যয় নিয়ে কাউকে কিছু না বলে স্ত্রী শিশুকন্যা মমতাজকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন জয়নাল আবেদীন।
প্রায় ২৮ বছর রিকশা চালিয়ে জমানো পৌনে তিন লাখ টাকা নিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন তার গ্রামের বাড়িতে। ২০০১ সালের এক শুক্রবার সকালে গ্রামের মানুষকে ডেকে বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য তার স্বপ্নের মমতাজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা জানান। গ্রামের সবাই তার কথা শুনে সে সময় হাসাহাসি করে। এমন কথা শুনে হাসি থামাতে পারেনি তার পরিবারের সদস্য, স্ত্রী ছেলেমেয়েও। সবাই ভাবল দীর্ঘদিন রিকশা চালিয়ে জয়নাল আবেদীনের মাথাটাই বুঝি গেছে। শুধু তাই নয়, নিয়ে অনেকেই অবজ্ঞা করেছে, অপমানও করেছে তাকে।
সে সময় সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও পাশের গ্রামের যুবক পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন তার পাশে এসে দাঁড়ান। অনেক কষ্টে জমানো টাকায় ২৪ শতক জমি কিনে ২০০১ সালে ছোট একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর তৈরি করে জয়নাল আবেদীন মেয়ের নামে চালু করলেন মমতাজ হাসপাতালের কার্যক্রম। যেখানে প্রতিদিন অসুস্থ মানুষদের বিনামূল্যে সকাল-বিকেল চিকিৎসা করা শুরু করেন পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। শুধু তাই নয়, রোগীদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধও লে দেন জয়নাল আবেদীন।
সে থেকে পথচলা শুরু মমতাজ হাসপাতালের। কিন্তু রোগীদের ওষুধ কেনার জন্য প্রয়োজন অর্থ। কে পাশে দাঁড়াবে আর না দাঁড়াবে তার জন্য বসে থাকেননি জয়নাল। নিজের দেহঘড়ি যতক্ষণ চালু আছে ততক্ষণ হাসপাতাল চলবে- এমন প্রত্যয়ে তাই বয়স ষাট পেরিয়ে গেলেও জীরণকায় শরীর নিয়ে তিনি সারা সপ্তাহ ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতেন। আর কষ্টার্জিত সব অর্থ দিয়ে হাসপাতালের জন্য বিভিন্ন ওষুধ কিনে আবার বাড়ি ফিরতেন জয়নাল আবেদীন।
তার এমন কর্ম দেখে যারা তাকে এতদিন পাগল ভেবে এসেছিল, বিভিন্ন সময় কটূক্তি আর অপমান করেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করে। সে সময় গড়ে প্রতিদিন গ্রামের দরিদ্র ৩০-৪০ জন মানুষ  হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ওষুধ পেতে থাকে। এসব দেখে জয়নালকে পাগল না ভেবে তারা ধীরে ধীরে বন্ধু ভাবা শুরু করে। পরিবর্তন আসে পরিবারের সদস্যদের মাঝেও। স্ত্রী মোছা. লালবানু, ছেলজাহিদ হাসান, ছেলের বউ, নাতনি ভাইবোন সবাই তখন তার পাশে এসে দাঁড়ান।
সহযোগিতা চাইতে গিয়ে আরেক অপমানের ফসল বিদ্যালয়। তিনি জানান, ২০০৬ সালে ৎকালীন সমাজকল্যাণ সচিব আমাকে হাসপাতালের জন্য বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সে টাকায় গ্রামের দরিদ্র শিশুদের মক্তব পড়ার জন হাসপাতালের পাশে একটি টিনের দোচালা ঘর তুলে মক্তব পড়ানোর ব্যবস্থা করি। গত ২০০৭ সালে মক্তবের জন্য এক ব্যাংকে (ডাচ্-বাংলা) আর্থিক সহযোগিতার জন্য আবেদন করতে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর এক কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে আবেদন চান। আমি লেখাপড়া জানি না জানিয়ে আবেদন লিখে দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি আমাকে অপমান করে বলেন, নিজে লেখাপড়া জানে না আবার এসেছেন লেখাপড়ার সাহায্য নিতে। খালি হাতে বাড়ি ফিরলেও সেদিন আরেক শপথ নিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় গণশিক্ষার স্কুলে ভর্তি হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে নাম স্বাক্ষর করতে শিখি। আর শপথ করি যেভাবেই হোক আমার মতো আমার গ্রামের আর কেউ যেন নিরক্ষর না থাকে তার জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলব। তারপর থেকে শুরু করি প্রাথমিক বিদ্যালয় মক্তবের কাজ। সকালে মক্তব পড়ানোর পর সকাল দশটা থেকে ৩টা পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার পাঠদান শুরু করি।
২০১১ সালে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনের পর বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সংগঠন তার পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সহযোগিতায় হাসপাতালের নামে প্রায় চার একর ফসলি জমি কেনা হয়েছে। নতুন ঘর তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি গরুর খামার। হাসপাতালে বিদ্যু সংযোগ আনা হয়েছে।
শুরু থেকেই পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী দেখছেন। মো. আলী হোসেন জানান, সে সময় জয়নাল কাকা আমার কাছে আসেন সহযোগিতার জন্য। তার এমন নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্যটি আমার ভালো লাগে। আমি পাশে দাঁড়াই। নিয়ে গ্রামের মানুষজন কেবল তাকে নয়, আমাকেও নানারকম টিট্কারি মারত, হাসাহাসি করত। আমাকে শুনিয়ে বলত, জয়নালের হাসপাতালে চাকরি করে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জন রোগী আসেন। বেশিরভাগ রোগিকেই সাধ্যমতো সাধারণ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন প্রায় এক-দেড় হাজার টাকার ওষুধ লাগে। প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ছে বিধায় ব্যয় নির্বাহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
জয়নাল আবেদীন জানান, ২০০৫ সালে আমেরিকা প্রবাসী শাহনাজ পারভীন নামে এক মহিলা এক হাজার ডলার হাসপাতালের উন্নয়নে তাকে সহযোগিতা দেন। সে টাকায় হাসপাতালের জন্য আরো একটি ঘর, কিছু আসবাবপত্র একটি ছোট পুকুর খনন করি। জয়নালের ছেলে জাহিদ হাসান জানান, বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালটি পরিদর্শনে এসেছেন বর্তমান মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এমপি, সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্ট (অব.) মজিবর রহমান ফকিরসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অগণিত ব্যক্তিবর্গ। নাম প্রকাশে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক অসংখ্য মানুষের আর্থিক সহযোগিতা আর ভালোবাসায় বর্তমানে হাসপাতাল বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলছে সুন্দরভাবে। এলাকার মানুষও আজ আমাদের পরিবার তথা বাবার স্বপ্নের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন। মন্ত্রী মহোদয়দের নির্দেশে হাসপাতালটির সঙ্গে পাকা সড়কের সংযোগের দেড় কিলোমিটার কাঁচা সড়কের পাকাকরণের জন্যও মাপঝোঁক হয়েছে। আর বিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য সরকারি বইও পাওয়া যাচ্ছে।
পার্শ্ববর্তী হইল্লামাড়ি গ্রামের বৃদ্ধা আমেনা খাতুন বলেন, চাইর-পাঁচ মাইল দূরে শরীর খারাপ লইয়া আইট্টা পরানগঞ্জ হাসপাতালে যাইতেই সারা। এহানে আইসা উপহার পাই, তাই আই। পাশের গ্রামের মেগজান বিবি, ময়না খাতুন, হাজেরা খাতুন খাদন মিয়া সবাই এক সুরে বলেন, জয়নাল আমরার গরিবের বন্ধু। গ্রামের আর কেউ তো এমনে আমরার কাছে আয় না।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক ডা. মতিউর রহমান ভূঁইয়া বলেন, জাতীয় উদ্যোগ বিরল। এসব ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন তার প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন, আমার এই শেষ বয়সে তেমন কিছু চাওয়ার নেই। এলাকার মানুষ যে এখানে আসেনÑ এটাই আমার বড় পাওয়া। হয়তো জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না এখানে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল বিদ্যালয় হয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, কোনো এক সময় আমার স্বপ্ন সাধারণ মানুষের স্বপ্নে রূপ বে।
মো. কামরুজ্জামান তুহিন, স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ

Please See www.aljazeera.com's Video:


Please browse this related blog-sitehttp://freetreatmentbd.blogspot.com/

No comments:

Post a Comment